বিকেল থেকে পাড়ে বসে একের পর এক ঢেউ ভাঙা দেখে চলেছে পৃথা। এই জায়গাটা সামান্য নির্জন, হোটেলের একদম সামনে। সন্ধ্যের আকাশের সূর্যাস্তের রঙ সাগরের জলে মিলেমিশে অপূর্ব মোহময় করে তুলেছে। ঝুপ করে সূর্য ডুবতেই কখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল পৃথা খেয়াল করেনি। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ঝালমুড়ি, গরম কেটলিতে লেবু চা নিয়ে পৃথার সামনে এসে সেধে যাচ্ছে ফেরিওয়ালারা। আজ অনেকদিন পর ছোটবেলার হাজার স্মৃতি ঢেউয়ের মতো মনের ভেতরে আছড়ে পড়ছে। ছোটবেলায় বাবা মায়ের সঙ্গে একবার এসেছিল। ওর খুব অল্প বয়সে বাবা হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ বারবার বাবার কথা মনে হচ্ছে। বিয়ের পর এই আবার পুরীতে আসা।
দীপক দুপুরে বেশ কটা বিয়ার খেয়ে এমন ঘুম দিয়েছে যে কখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে টের পায়নি। গলাটা খুব শুকিয়ে গেছে দীপকের। বিছানার পাশের আলোটা জ্বালিয়ে দেখে পৃথা ঘরে নেই। নিশ্চয়ই বারান্দায় বসে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো… ইশশশ্! ভেবেছিল বিকেলে পৃথাকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাবে! বারান্দায় পৃথাকে দেখতে না পেয়ে বিচের দিকে খুঁজতে লাগলো। বৃথা চেষ্টা। এত জোরালো আলো চারদিকে যে বিচটার কোথায় কী কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।
পুরীর সমুদ্র পৃথাকে যতটা টানে, পুজোর ব্যাপারে ওর তেমন কিছু এসে যায় না। তবে এবার একবার জগন্নাথ মন্দিরে যাবে ঠিক করেছে। এত অসাধারণ এই মন্দিরের কারুকার্য, সামনে থেকে দেখে চোখ সার্থক করতে চায়।
হঠাৎ পিঠে হাত, প্রচণ্ড চমকে পেছন ফিরে দেখে দীপক হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। ‘কী, চা- টা কিছু খেয়েছ? নাকি শুধুই সমুদ্রের হাওয়া!’
দীপকের কথায় পৃথা হেসে ফেলল…‘বাপরে! তুমি যা ঘুম দিয়েছিলে, ভাবছিলাম এক্কেবারে ডিনার করে নেবো। বিকেলের চা, বাদাম ভাজা বাদ।’
কথা বলতে বলতে দীপক বউয়ের পাশে বসলো। হাওয়ায় পৃথার চুল এলোমেলো ভাবে মুখে এসে পড়ছিল। ওরা দুজনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, দূর অন্ধকারে জেলেদের নৌকার টিম টিম আলো দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আকাশের তারাগুলো সাগরের জলে ভেসে চলেছে।
দীপক একটু অভিমান নিয়ে বলল, ‘তুমি আমায় না ডেকে একলা চলে এলে?’
পৃথা বালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল…‘ইচ্ছে করেই ডাকিনি, সমুদ্রের সঙ্গে একা একা কথা বলব বলে। কতকাল পর এলাম বলো তো? ’
কিছুটা পথ বালির ওপর দিয়ে হেঁটে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানে এল ওরা। এখানে মাটির ভাঁড়ে চা দেয়। ওদের বছরখানেক হলো বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরপরই থাইল্যান্ড গিয়েছিল হনিমুনে। কিন্তু বহুদিনের ইচ্ছে ছিল পৃথার, একবার পুরী আসবে। ছোটবেলার পর আর আসা হয়নি। ঠিক হয়েছিল বাড়ির সকলে মিলে আসবে, কিন্তু হল না। শ্বশুরের কাজ পড়ে গেল। দীপকের মা বাবা পৃথাকে একদম মেয়ের মতো ভালবাসেন। ওঁরা এলে মাকেও নিয়ে আসবে ঠিক ছিল।
চা খেতে খেতে পৃথা বলল…‘কাল আমাদের সকাল সকাল মন্দির দেখতে যেতে হবে, মনে আছে তো?’
দীপক, হুমম্ বলে আপন মনে হাঁটতে শুরু করল। পাণ্ডাদের দৌরাত্ম্য, পুজো দেওয়া দীপকের একেবারেই মনঃপুত না, তবু পৃথার সেন্টিমেন্টে আঘাত করবে না বলে চুপচাপ থাকল।
‘জগন্নাথের ভোগটা কিন্তু অসাধারণ খেতে হয়।’
দীপকের কথায় হেসে ফেলে পৃথা, ‘তুমি ঠিক আমার বাবার মতো বললে, মা বলতো বাবা নাকি মন্দিরের ভোগ খেতে ভীষণ ভালোবাসত। আমার অবশ্য স্বাদ কিছুই মনে নেই।’
রাতে হালকা ডিনার করে বারান্দায় বসে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ উপভোগ করছিলো ওরা। চারদিক শান্ত, ঝুপড়ির দোকানদাররা আলো নিভিয়ে ঝাঁপ ফেলে ফিরে গেল যে যার ঘরে। নোনা হাওয়ায় বেশ একটা নেশার মতো ঘুম জড়িয়ে এল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে নেই, নানা রকম উদ্ভট স্বপ্ন দেখে বিছানায় উঠে বসল পৃথা। …চারিদিক অন্ধকার, সবাইকে ডাকছে ও, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। একটা বিরাট ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে.. ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল আবার। বাবা যখন সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন ওর মাত্র সাত বছর। বাবার চলে যাওয়া মা কোনও দিন মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সেই থেকে পৃথাও সব হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে থাকে।
দীপক বেশ কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে ঘুরে ঘুরে দেখছিল মন্দিরের সৌন্দর্য। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, দীপকের খুব খিদে পেয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে যেই নামতে যাচ্ছে, কোথা থেকে এক সাধুবাবা পৃথার সামনে এসে অদ্ভুত গলায় বলল, চিন্তা মৎ কর বেটি, ওহ জিন্দা হ্যায়… প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে পৃথা পড়েই যাচ্ছিল, সময় মতো দীপক ধরে ফেলেছিল বলে রক্ষে। নিজেকে সামলে পৃথা এদিক ওদিক খুঁজে ওই সাধুবাবাকে আর দেখতেই পেল না।
ভোরের দিকে এতটাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল পৃথা যে, অ্যালার্ম শুনতে পায়নি। দীপকের ডাকাডাকিতে উঠে বসল। চটপট তৈরি হয়ে মন্দির যেতে হবে। প্রসাধনহীন সাজ, সাদা খোলের চওড়া পাড়ের শাড়িতে পৃথাকে বেশ অন্যরকম সুন্দর লাগছিল।
দীপক অপলক চোখে চেয়ে থেকে বলল, ‘আরে! আমার সঙ্গে স্বয়ং দেবী থাকতে মন্দিরে যাওয়ার দরকার কী?’
পৃথা মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলল, ‘হঠাৎ হঠাৎ কী যে বলো, বুঝি না।’
হাজার রকমের চেকিং এর পর মন্দিরে ঢোকা। ভেতরে কোনও ছবি তোলা যাবে না শুনে দীপক একটু মুষড়ে পড়ল। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঠাকুর দর্শন করে অতিভক্তদের ঠেলে কোনোমতে ওরা বেরিয়ে এল। এত ভালোভাবে দেবতা দর্শন হয়েছে বলে পৃথা খুব খুশি। পান্ডাকে বিদায় দিয়ে পৃথা আর দীপক বেশ কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে ঘুরে ঘুরে দেখছিল মন্দিরের সৌন্দর্য। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, দীপকের খুব খিদে পেয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে যেই নামতে যাচ্ছে, কোথা থেকে এক সাধুবাবা পৃথার সামনে এসে অদ্ভুত গলায় বলল, চিন্তা মৎ কর বেটি, ওহ জিন্দা হ্যায়… প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে পৃথা পড়েই যাচ্ছিল, সময় মতো দীপক ধরে ফেলেছিল বলে রক্ষে। নিজেকে সামলে পৃথা এদিক ওদিক খুঁজে ওই সাধুবাবাকে আর দেখতেই পেল না। একটা অদ্ভুত অশান্তি হচ্ছিল মনে, সারা রাস্তা আর ভাল করে কথা বলতে পারল না পৃথা।
দুপুরে বেশ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বিকেল ওরা আবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসল। মাতাল করা নোনা হাওয়ায় মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল। হঠাৎ পৃথা বলে উঠল…‘উফফ্! আর আমি কোনও মন্দির টন্দির যাব না। যত্তসব উদ্ভট লোকজন আসে।’
দীপক অবাক হয়ে বলে,‘সে কি আমাদের এরপরে তো কেদারবদ্রী যাওয়ার কথা সবাই মিলে!!’
‘সে তো হিমালয়ের রূপ দেখতে যাওয়া, পুজো দিতে না। দূর থেকে মন্দির দেখে নিলেই হবে।’ পৃথা বলে।
বিয়ের পর এটা ওদের দ্বিতীয়বার বেড়ানো। দুজনে একই অফিসে কাজ করে কিন্তু একসঙ্গে ছুটি নেওয়া সব সময়ে সম্ভব হয় না।খুব বড় কোম্পানি, সেখানে পৃথা কন্টেন্ট রাইটারের কাজ করে। দীপকের ডিপার্টমেন্ট আলাদা, ও প্রোজেক্ট ম্যানেজার। এই কাজের সুবাদে ওদের আলাপ পরিচয়, প্রেম এবং বিয়ে। পৃথা কিছুটা নরম প্রকৃতির কিন্তু বেশ ব্যক্তিত্ব আছে।
ছোটবেলা থেকে বাবাকে পায়নি বলে দীপকের বাবার সঙ্গে পৃথার খুব সহজ সম্পর্ক। কে বলবে শ্বশুর বউমা। সব কিছুতেই শ্বশুর খুব আস্কারা দেন পৃথাকে। একান্নবর্তী পরিবারে ছোটবেলাটা কেটেছে পৃথার। জ্যাঠা কাকা ভাই বোন সবাই মিলে হইহই করে থাকত। বাবা চলে যাবার পর কবে যে ধীরে ধীরে সব আলাদা হয়ে গেল পৃথার ঠিক মনে পড়ে না। মা যে প্রাইভেট স্কুলে পড়াতো সেই স্কুলেই পৃথা লেখাপড়া শেষ করেছে। মা আর মেয়ে মিলে একটা ছোট ভাড়াবাড়িতে থাকত। পৃথা যখন মাস্টার্স করে তখন ওদের নিজেদের একটা ফ্ল্যাট হয়। মা একা কতটা কষ্ট করেছে বোঝে। আজ ওর জীবনে যে সফলতা এসেছে সবটাই সম্ভব হয়েছে মায়ের জন্য। বাবার ওপর খুবই অভিমান হয়। কী এমন হয়েছিল যে বাবা সংসারত্যাগী হয়ে গেল! মা তো আজও চোখের জল ফেলে আড়ালে। কারণে অকারণে নিজেকে দোষারোপ করে পৃথার মা। কিন্তু যে নিজের ইচ্ছেতে হারিয়ে যেতে চায়, তাকে কী ভাবে খুঁজে পাবে?
সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল পৃথা যে, দীপকের কথা শুনতে পায়নি।
‘কী হল?আজ কী ডিনার হবে, চাইনিজ নাকি বিরিয়ানি?’
ইশশ্!! কখন থেকে চুপ করে বসে আবোল তাবোল ভেবে চলেছে পৃথা, খুব লজ্জা লাগল।
‘নাহ্, এখানে বিরিয়ানি খাবো না, চাইনিজ চলে তবু।’ চারদিকে লোকজন কমে গেছে দেখে ওরাও উঠে পড়ল। নিজেদের হোটেলেই খাবার অর্ডার করে ঘরে চলে এল। এবারের মতো ছুটি শেষ, পরদিন ফেরা।
দিন দিন ওদের কাজের চাপ এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে, ইচ্ছে থাকলেও অনেকদিন আর বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে যাবে বলেই আরও হয়নি। দীপকের মায়ের দমের কষ্ট হয়, তাই কেদারবদ্রী বাতিল করে শেষ পর্যন্ত হিমাচল যাওয়া ঠিক হল। সিমলা কুলু মানালি ঘুরে আসবে সবাই। শুনেই পৃথার আনন্দে মুখ উজ্জ্বল। ম্যাপ নিয়ে বসে রুট ঠিক করে ফেলল, সেই সঙ্গে হোটেল বুকিং। সিমলা থেকে সারাহান যাবে, ভীমাকালীর মন্দির আছে ওখানে, অসাধারণ পাহাড়ের দৃশ্যের কথা শুনেছে।
দু’সপ্তাহ পর রওনা। এই ক’টাদিন যেন কাটতে চায় না দীপক আর পৃথার। দীপকের মা শান্তা আর পৃথার মা লীনা— দুই মা-ই চিন্তায়, এতটা ধকল নিতে পারবে কিনা!
কালকা থেকে টয় ট্রেনে সিমলা যাবে বলে ওরা প্লেন করেনি। সবটাই শ্বশুর আর বৌমার প্ল্যান। ফেরার পথে দিল্লি থেকে প্লেন। দু’দিকে কাঁচের জানলা, ছোট ট্রেন পাহাড়ি রেললাইন ধরে এঁকে বেঁকে চলেছে। দীপক ছবি তুলেই যাচ্ছে। বাবা মায়েরাও এই দৃশ্য দেখে ছেলেমানুষের মতো খুশি। তিনদিন সিমলাতে যা যা পারল দেখে দুর্দান্ত সময় কাটল ওদের। সেখান থেকে সারাহান যখন পৌঁছল সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। হোটেলটা ভীমাকালী মন্দিরের খুব কাছে। ঘরের জানলা দিয়ে শুধুই পাহাড়ের স্তর দিগন্ত বিস্তৃত। নীচের দিকে কতটা গভীর বোঝা যায় না। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক অন্ধকার। সেই সঙ্গে ঝুপ করে ঠান্ডাও চেপে ধরল। সন্ধ্যারতির ঘন্টার আওয়াজ পেতেই ওরা মন্দিরের দিকে রওনা হল। মন্দিরের স্থাপত্য অসাধারণ, কোনোদিন এরকম দেখেনি ওরা। দিনের আলোয় আরও সুন্দর দেখায় পাহাড় ঘেরা এই মন্দির। পৃথা আর দীপকের পুজো দেওয়ার কোনই ইচ্ছে নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অপূর্ব সুন্দর মন্দির ঘুরে দেখাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু দুই মা পুজো দেবেন।
মেলার মতো চারদিকে ছোট ছোট দোকান বসেছে, কী একটা উৎসব আছে তিনদিন ধরে। নানান সাধু সন্ন্যাসী আসছেন দূর দূর থেকে। জেনেই পৃথার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল… শান্তিতে একটু প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে পারবে না!! পরদিন সকাল সকাল শান্তা আর লীনা দীপকের বাবাসহ মন্দিরে চলে গেলেন। পৃথা, দীপক ডাইনিং রুমে গিয়ে ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসল। চারদিকে কাঁচের জানালা, পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। এই হোটেলটা একদম পাহাড়ের কিনারায়। জানালার ওপারে দেখা যায় গভীর খাদ। একটু ভয় ভয় করে।
ভিড় হওয়ার আগেই মন্দির ঘুরে দেখতে হবে বলে ওরা বেরিয়ে পড়ল। কিছু সন্ন্যাসী সন্ন্যাসীনির আগমন শুরু হয়েছে, ছোট ছোট কাপড়ের ছাউনি করে তাঁরা বসেছেন। নানা দিক থেকে ভক্তদের আসা যাওয়া চলছে। পৃথারা মা’দের কাউকে দেখতে পেল না ধারেকাছে, নিজেরাই ভাল করে মন্দিরের ভেতরটা দেখে বেরিয়ে এল। ওই চত্বরে যে সব সাধু বসে ছিলেন সবাই রক্তচক্ষু জটাধারী না, শান্ত স্নিগ্ধ সাদা পোশাকেও অনেকে ছিলেন।
ভিড় একটু হালকা হতেই লীনা সাধুর সামনে হাত বাড়িয়ে বসে পড়লেন। দু’জনেই দু’জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। পৃথা দেখল মায়ের চোখ ধীরে ধীরে বুজে আসছে। বোঝাই যায় সাধু হিপনোটাইজ করছে, তখনও সাধু মায়ের হাতটা ধরে।
পৃথা এক টানে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মাকে বকা লাগাল, ‘মা, কতবার বলি এইসব ভন্ডদের বিশ্বাস করবে না। এরা অনেক কিছু ক্ষতি করে দেয়, এক্ষুনি উঠে এসো।’ সাধু এক অদ্ভুত মায়ার চোখে পৃথাকে দেখতে লাগলেন।
দীপক বলল… ‘দেখ, এখানে যত সব বুজরুকি চলবে। শিকড়বাকড়, মন্ত্রপূতঃ পাথর, জড়িবুটি কত কিছু পাওয়া যাবে। আর ভক্তরা তাই বিশ্বাস করে নিয়ে যাবে।’
যেতে যেতে দেখে এক জায়গায় বেশ ভিড়, ন্যাড়ামাথা লম্বাদাড়ি এক সাধু সবার ভূত ভবিষ্যত বলে দিচ্ছেন। তারই কাছাকাছি পৃথার মা দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছেন। দীপকের মা বাবা গেছেন মিষ্টি কিনতে, গরিব বাচ্চাদের দেবেন বলে। পৃথা মায়ের কাছে গিয়ে ডাকতেই অসম্ভব চমকে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
দীপক ফাজলামি করে বলল ‘কী হল মাসি! মেয়েকে চিনতে পারছ না?’
লীনার হাসিটা কেমন শুকনো দেখাল। আস্তে করে বলল, ‘ভাবছি এঁর কাছে একবার হাতটা দেখাব, সবাই তো ভাল বলছে।’
পৃথা যথাসম্ভব বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। ও এসব একদম বিশ্বাস করে না। কিন্তু ভিড় একটু হালকা হতেই লীনা সাধুর সামনে হাত বাড়িয়ে বসে পড়লেন। দু’জনেই দু’জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। পৃথা দেখল মায়ের চোখ ধীরে ধীরে বুজে আসছে। বোঝাই যায় সাধু হিপনোটাইজ করছে, তখনও সাধু মায়ের হাতটা ধরে।
পৃথা এক টানে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মাকে বকা লাগাল, ‘মা, কতবার বলি এইসব ভন্ডদের বিশ্বাস করবে না। এরা অনেক কিছু ক্ষতি করে দেয়, এক্ষুনি উঠে এসো।’ সাধু এক অদ্ভুত মায়ার চোখে পৃথাকে দেখতে লাগলেন।
হোটেলে ফিরে লীনা চুপচাপ শুয়ে রইলেন, দুপুরে কিছুই খেলেন না। দীপকের মা বাবাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। বিকেলের দিকে দীপক পৃথা একটু এদিক ওদিক ঘুরতে বেরোল, টুকটাক শৌখিন কিছু কেনাকাটাও করবে। পরদিন সকালে কুলু মানালি রওনা।
সকালে সবেমাত্র সূর্যের আলো পাহাড়ের গায়ে এসে পড়েছে, পৃথাদের ঘরের দরজায় ঠুকঠুক শব্দ। হালকা স্বরে মায়ের ডাক শুনলো পৃথা। সামান্য দুশ্চিন্তা নিয়ে দরজা খুলে দেখল মা তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে, বেশ সতেজ লাগছে, কালকের ক্লান্তি চোখে মুখে আর নেই।
‘আমার সঙ্গে একবার মন্দির যাবি? দেখেই চলে আসব। আজই তো ফিরে যাচ্ছি।’ অনুরোধটা ফেলতে পারলো না ও। চটজলদি তৈরি হয়ে মাকে নিয়ে বেরোল। মন্দির চত্বরে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে মা শুধু ওই সাধুবাবাকে খুঁজছিলেন। মন্দিরের পুরোহিতের কাছে জানা গেল, ভোরের আগেই উনি চলে গেছেন, কোথায় কেউ জানে না। লীনা খুব মুষড়ে পড়লেন। মায়ের এই অদ্ভুত আচরণে পৃথার বেশ আশ্চর্য লাগছিল। কিন্তু আলাদা করে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না। লীনাও চুপচাপ।
পরের দিনপাঁচেক ওদের বেশ ঘোরাঘুরি হল। মানালিতে পাহাড়ের ওপর চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা হিড়িম্বা দেবীর মন্দির এক অসাধারণ দর্শনীয় স্থান। খুব নির্জন জায়গা। বিকেলের পর বেশ থমথমে। দীপক আর পৃথা দারুণ উপভোগ করছিল এমন সৌন্দর্য। শুধুমাত্র লীনার চোখদুটো যেন কাউকে খুঁজে যাচ্ছিল অজান্তেই।
ফেরার পথে প্লেনে সকলেই বেশ ক্লান্ত, গা এলিয়ে বসে। অপূর্ব সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তবে এবার বাড়িবাড়ি মন করছে। মা মেয়ে পাশাপাশি বসেছে। একটা সময়ে পৃথা খেয়াল করল মায়ের দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
‘মা, তোমার কিছু কষ্ট হচ্ছে?’
লীনা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘জানিস, যে একবার হারিয়ে যায় তাকে কাছে পেলেও ধরে রাখা যায় না।’
পৃথা হতবাক, এতদিন পর হঠাৎ মা এটা কী বলছে!! তা হলে সেই সাধুকে মা চেনে? যাকে এতকাল ধরে মা মনে মনে খুঁজে গেছে!! তা হলে তো পুরীর সেই সাধু যা বলেছিল, মিলে গেল! এক অদ্ভুত অনুশোচনা হতে লাগলো পৃথার।